22 Nov 2024, 11:38 pm

ঋণ পরিশোধে রাশিয়াকে পাল্টা প্রস্তাব দিচ্ছে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : বাংলাদেশকে দেয়া ঋণ নিজস্ব মুদ্রা রুবলে পরিশোধের প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। কিন্তু বাংলাদেশে রুবলের কোন রিজার্ভ নেই। এমনকি দেশটিতে বাংলাদেশী শ্রমিক না থাকায় রেমিটেন্স আসারও সুযোগ কম। দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যের পুরোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে হওয়ায় অল্প রপ্তানির মাধ্যমেও যা আসে তা ইউরোতে পায় বাংলাদেশ।

এমন পরিস্থিতিতে ডলার বিক্রি করে অস্থিতিশীল মুদ্রা রুবলে ঋণ পরিশোধ বাস্তাবসম্মত মনে করছে না সরকার। এমতাবস্থায় রুশ প্রস্তাবের লাভ-ক্ষতি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করে দেশটিকে সরাসরি নেতিবাচক কোন জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রস্তাব প্রদানের প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। রাশিয়ার সঙ্গে চলামান এসব আলোচনায় ব্যবসায়িক দিক ছাড়াও কূটনৈতিক বিভিন্ন দিকও জড়িত রয়েছে। তাই  রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের সঙ্গে কোন ধরনের বৈরিতায় না জড়িয়েই সাবধানে এগোতে চাইছে ঢাকা। ফলে ভূ-রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক সময়ে পাল্টা প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। ইআরডি সূত্রে এমন তথ্যই জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাশিয়ান প্রস্তাবটি নিয়ে কাজ করা এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের রুবলে পরিশোধ করার মতো সক্ষমতা নেই। কারণ হিসেবে তিনি দেশে রুবলের রিজার্ভ না থাকাকে উল্লেখ করেন। তাছাড়া দেশটির সঙ্গে রপ্তানি কম থাকা আরেকটি বড় কারণ। যতটুকু রপ্তানি হয় তাও আবার ইউরোর মাধ্যমে হয়। সুতরাং রপ্তানি আয় হিসেবে ইউরো পায় বাংলাদেশ। আবার দেশটি থেকে অনেক রুবল পাঠানোর মতো উল্লেখযোগ্য কোন প্রবাসী শ্রমিকও নেই রাশিয়ায়। এমতাবস্থায় বৈশ্বিক অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ডলার বিক্রি করে রুবল ক্রয়ে বাড়তি ব্যয় ও ঝুঁকি থেকে যায়। তাই আপাতত কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও সম্পর্ক বজায় রেখে পাল্টা প্রস্তাব পাঠানোর কথা ভাবছে ঢাকা।

যেখানে রুবলে ঋণ ফেরত দিলেও চুক্তির বাইরে বাড়তি কোন টাকা না দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ঢাকায় রাশিয়ান ব্যাংকের শাখা খোলাসহ তেল ক্রয়ের জন্য রাশিয়ান অর্থায়নে দেশে তেল শোধানাগার স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে চাইলেও বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন করে কোন ঝুঁকি তৈরি করতে চায় না বাংলাদেশ। তবে সর্বোপরি রুবলে ঋণ পরিশোধ সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট  ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

ইআরডি সূত্রমতে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই বা ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি বাবদ ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছিল রাশিয়া। এই ঋণ সুদাসলসহ আটটি কিস্তি পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। তবে শেষ সময়ে এসে ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় পড়ে রাশিয়া। ফলে ঋণের ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ বা ১০০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১০ কোটি ডলার এখনো বকেয়া রয়ে গেছে। সংকট নিরসনে রাশিয়া তাদের নিজস্ব মুদ্রা রুবল বা চীনের ইউয়ানে ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশকে। এদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৯০ শতাংশ ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। ২০২৭ সালের মার্চ মাস থেকে রাশিয়াকে ৬০ বছর মেয়াদে এ কেন্দ্রটির সুদাসল পরিশোধ শুরু করবে সরকার। রূপপুর প্রকল্পে ব্যয় ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের কিছু বেশি বা প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার সমান। ফলে এ বিশাল ঋণ পরিশোধ রুবলে দেওয়া জটিল একটি প্রক্রিয়া।

এর আগে ঋণ পরিশোধ নিয়ে রাশিয়া বাংলাদেশকে দুটি চিঠি দিয়েছে। প্রথম চিঠি দেওয়া হয় গত ২৩ জুন। এতে দুই দেশের মধ্যে সই করা আন্তঃসরকার ঋণচুক্তির (আইজিসিএ) ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এরপর গত ১০ আগস্ট আরেকটি চিঠি দেয় রাশিয়া। এতে মার্কিন ডলার ও ইউরোতে লেনদেন নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে রুবলে লেনদেনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। রাশিয়ার প্রস্তাব হলো, রুবলে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার ও রুবলের বিনিময় হার হবে রুশ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিনিময় হার অনুযায়ী। প্রকৃত পরিশোধের তারিখের ১০ দিন আগের দরটি বিনিময় হার হিসেবে ধরা হবে।

রুবলের জটিলতা: ইআরডির পর্যালোচনায় রাশিয়ার ঋণের সুদাসল রুবলে পরিশোধের ক্ষেত্রে কয়েকটি সমস্যা চিহ্নত করা হয়। ১. মুদ্রা পরিবর্তনের ফলে বাড়তি ব্যয় যুক্ত হবে। ২. রাশিয়ার মুদ্রার বিনিময় হার ডলারের মতো স্থিতিশীল নয়। ৩. কয়েক দফা চুক্তি নবায়নে দীর্ঘসূত্রতা  ৪.পশ্চিমা চাপের আশঙ্কা।

ইআরডির রাশিয়া নিয়ে কাজ করা সূত্র বলছে, প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় যে চুক্তি করা হয়েছিল শেষ সময়ে এসে তা আবার নতুন করে করতে হবে। ওই চুক্তিতে ঋণ পরিশোধে ডলারকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারের কথা বলা হয়। প্রথমত সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি নবায়ন করতে হবে। তাছাড়া দুই দেশের মধ্যে ব্যাংক পর্যায়ে আবার চুক্তি করতে হবে। যা অনেক সময়সাপেক্ষ এবং লেনদেনের শেষ পর্যায়ে এসে অনেকটা জটিল হবে।

এদিকে রুবল ও ইউয়ানে পরিশোধ করতে হলে পার করতে হবে কয়েকটি ধাপ। প্রথমে ইউয়ানে চীনে এবং পরে চীন থেকে আবার রুবলে রাশিয়ার টাকা পাঠাতে হবে। আর রুবল বা ইউয়ানও ডলার বিক্রি করে কিনতে হবে। কারণ রুবল বা ইউয়ানের তেমন কোনো শক্ত সোর্স বাংলাদেশের নেই। এছাড়া রুবলের রেট সব সময় ওঠানামা করে। সেই হিসেবে ডলার অনেকটাই স্থিতিশীল। সুতরাং, রুবলে দিলে বাজারদর ওঠানামা করায় বাড়তি ব্যয় যুক্ত হতে পারে।

ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের শুরুর দিকে রুশ মুদ্রা রুবলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অবনমন হয়েছিল। গত মার্চে প্রতি ডলারে ১৩২ রুবল ও ইউরোতে ১৪৭ রুবলে নেমে আসে। যেখানে ফেব্রæয়ারির মাঝামাঝি সময়ে  ১ ডলারের বিপরীতে ছিল ৭৫ রুবল ও ইউরোর বিপরীতে ছিল ৮৫ রুবল। মার্চের শেষর দিকেই ফের ১ ডলারের বিপরীতে ১০০-এর নিচে নেমে ৯৫-এ স্থির হয় রুবল। ইউরোর বিপরীতেও ৩.৫ শতাংশ দাম বেড়ে প্রতি ইউরো বিনিময় হয় ১১০.৫ রুবলে। এ রিপোর্ট লেখার সময় ১ ডলারের বিপরীতে রুবলের বাজারদর ছিল ৬২ রুবল এবং ইউরোর বিপরীতে ৬০ রুবল।

ইআরডির পর্যালোচনায়, একাধিকবার মুদ্রা পরিবর্তনের ফলে ঋণের ব্যয় ও ঝুঁকি অনেক বাড়বে। তাছাড়া রুবলের বাজার সকালে এক থাকলেও বিকেলে আরেক রকম হয়ে যায়। যুদ্ধের তীব্রতার সঙ্গে বাজারদরও পরিবর্তিত হয়ে যায়।

বাংলাদেশের প্রস্তাব: ইআরডির ইউরোপ শাখা নিয়ে কাজ করা এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা পাল্টা প্রস্তাব তৈরি করছে ইআরডি। যেহেতু চুক্তির বাইরে গিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া তাই বাংলাদেশের তা মেনে নেওয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বরং তারাই বাংলাদেশের প্রস্তাবগুলো ভেবে দেখতে পারে। প্রথমত মুদ্রা পরিবর্তনের ফলে যে বাড়তি ব্যয় যুক্ত হবে তা বহন করবে না বাংলাদেশ। কারণ ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশর কোন সমস্যা নেই বরং তারাই তা গ্রহণ করতে পারছে না। তাই চুক্তিমতে যে পরিমাণ ডলার বাকি আছে শুধু সে পরিমাণ অর্থই পাবে রাশিয়া।

দ্বিতীয়ত ঢাকায় রাশিয়ান ব্যাংকের শাখা খোলার প্রস্তাব দিবে বাংলাদেশ। দেশে ভারত, পাকিস্তান, কোরিয়াসহ বেশ কিছু দেশের ব্যাংক থাকলেও রাশিয়ার কোন ব্যাংকের শাখা নেই। ফলে লেনদেনে সমস্যা হয়। তাছাড়া নিজস্ব সরাসরি যোগাযোগ না থাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়। তবে সরাসরি লেনদেন ও যোগাযোগ তৈরি করতে পারলে সহজে বেশি পরিমাণ ব্যবসা করা যাবে। আর সরাসরি রুবল পাওয়ার সুযোগও তৈরি হবে।

তৃতীয়ত তেল শোধনাগার তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হবে। দেশে যে শোধনাগার রয়েছে সেটার মাধ্যমে রাশিয়ান তেল পরিশোধন করা সম্ভব না। তবে রাশিয়ান অর্থায়নে উচ্চমানের শোধনাগার করা গেলে রাশিয়ান তেল পরে শোধন করা সম্ভব হবে। বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি থাকলেও ভারত মাত্র ৪০ ডলারে সে তেল কিনে লাভবান হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি একই দামে কিনতে পারে তাহলে পরিশোধন করতে আরও ২০ ডলার ব্যয় হলেও মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৬০ ডলার। অর্থাৎ অন্য দেশের তুলনায় ৪০ ডলার কম খরচে মিলবে তেল। এমন পরিকল্পনা থেকে রাশিয়ান অর্থায়নে দেশে একটি অত্যাধুনিক শোধনাগার তৈরির প্রস্তাব দিবে ঢাকা।

চতুর্থ বিষয় হিসেবে কূটনৈতিক বিষয়টি নিয়েও ভাবছে ঢাকা। রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি রুবলে লেনদেন করলে পশ্চিমা বøক থেকে কোন প্রতিক্রিয়া আসবে কিনা সেটা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কারণ রাশিয়ার প্রস্তাব রাখতে গিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোন ঝামেলা চায় না ঢাকা। তাই এ বিষয়টি মাথাই রেখেই উপযুক্ত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে প্রস্তাবের জবাব দেওয়ার কথা ভাবছে ঢাকা। রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন অনেক নিষেধাজ্ঞাই কার্যকর হচ্ছে না বিধায় খুব বড় ধরনের কোন প্রতিবন্ধকতার আশঙ্কা দেখছে না বাংলাদেশ।

রুবলে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের তো অনেক বেশি রপ্তানি হয় না রাশিয়ায়। ফলে রুবল কোথায় পাবে বাংলাদেশ? আর বাণিজ্য উদ্বৃত্তও নাই। এমন পরিস্থিতিতে ডলার কিনে আবার রুবল কিনলে লস হবে বাংলাদেশের। তাই এ প্রস্তাবটি বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে না।

উল্লেখ্য, রাশিয়ান প্রস্তাব সরাসরি নাকচ না করে কৌশলী পদক্ষেপ হিসেবে পাল্টা প্রস্তাব দিচ্ছে বাংলাদেশ। দেশটির সঙ্গে একইসঙ্গে ব্যবসা বড়াতে চাইলেও পশ্চিমা চাপ যেন না আসে সে দিকটিও খোয়াল রাখছে ঢাকা। বাংলাদেশ কোন ঝামেলা না বাড়িয়ে নিজের স্বার্থ অক্ষুণœ রাখবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে বলা হচ্ছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 9046
  • Total Visits: 1272157
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ২০শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, রাত ১১:৩৮

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018